২০২০ এবছরের ধনতেরাস এর শুভ মুহূর্ত – ১২ ই নভেম্বর রাত ৯:৩০ মিনিট থেকে ১৩ ই নভেম্বর বিকাল ৫:৫৯ মিনিট
কার্তিক মাসে ভারতবর্ষে যে অনুষ্ঠানগুলিতে আমরা মেতে উঠি তার মধ্যে ধনতেরাস, দীপাবলি অন্যতম। অমাবস্যা তিথিতে যখন আমরা দীপাবলি মানাই, ত্রয়োদশী তিথিতে অর্থাৎ দীপাবলির দুইদিন আগে ধনতেরাস আয়োজন করা হয়। সাধারণতঃ এই দিনে ধনদেবতা কুবেরের পূজা করা হয় তার সাথে লক্ষ্মী ও যমেরও পূজা করা হয়। এটাই মানা হয় যে ধনতেরাসের দিন ক্ষীরসাগর মন্থন করা হয় এবং সেখান থেকে মা লক্ষ্মী ও ভগবান কুবের প্রকট হয়ে সকলকে দেখা দেন। এভাবেই এই শুভ দিনের সূচনা হয়। আর এই জন্যে ধনতেরাসের দিনে মঙ্গল কামনায় কিছু জিনিস কেনার প্রথা চলে আসছে। তবে এই কেনাকাটার মধ্যেও কিছু প্রকারভেদ আছে।
কেন এই রীতি, আসুন জেনে নেওয়া যাক ধনতেরাস পালনের প্রথা
কথিত আছে, সমস্ত দেবতাদের কবিরাজ ধন্বন্তরী যখন সমুদ্র মন্থনের সময় আবির্ভাব হয়েছিলেন তখন তার হাতে একটি অমৃত কৈলসপত্র দেখা গিয়েছিলো, সেখান থেকেই এই দিনে বাসন কেনার প্রথা চালু হয়। আর এই কলসপত্র আয়ুর্বেদ নামেও পরিচিত। তাই ভগবান ধন্বন্তরীকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনকও বলা হয়। আর ভগবান কুবের রুপার জিনিস পড়তে ভালোবাসেন তাই মনে করা হয় , রুপার বাসন এই দিনে কিনলে সংসারের সম্পদ প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে। তবে রুপার বাসন ছাড়াও কয়েন, গয়না কেনারও চল আছে। আর এই সিকি গুলোতে লক্ষী মাতা, ভগবান ধন্বন্তরী , কুবেরের ছবি দেওয়া থাকে যেগুলো অনেক মানুষ কিনতে ভালোবাসেন। এছাড়াও লক্ষ্মীর কচ্ছপ, চুরি , নোয়া এগুলিকেও অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। আর ধনতেরাসের দিন এগুলি ক্রয় করে দীপাবলির দিন সেগুলিকে পূজা করা হয়। সেগুলিকে যত্ন করে ঘরের দেরাজে রাখা হয়। ধনতেরাসের দিন ধনলক্ষ্মী সবার বাড়িতে প্রবেশ করেন আর পরিষ্কার পরিছন্ন বাড়ি ছাড়া তিনি কোনো বাড়িতে প্রবেশ করেন না এই বিশ্বাসে ধনতেরাসের আগে থেকেই চলে ঘরদোর পরিষ্কার করার পালা।
সাধারণত কৃষ্ণপক্ষে এই অনুষ্ঠান করা হলেও আলোর সাজসজ্জাতে সেই অন্ধকার কোথায় মিলিয়ে যায় আর তার সাথে বিভিন্ন রকম আতসবাজির সাহায্যে আলোর রোশনাই তো আমাদের মনকে ভরিয়ে রাখে।
ধনতেরাস আপাতত দুটি শব্দ দিয়ে তৈরী। ধন অর্থাৎ অর্থ,সম্পত্তি বা সমৃদ্ধি আর তেরাস অর্থাৎ তেরো বা ত্রয়োদশী তিথি। আর এই বছরে আমাদের সবথেকে কামনীয় জিনিসগুলির মধ্যে এই ত্রয়োদশী তিথিটিকে বলা যায় কারণ ১৩ই নভেম্বরের বিকেল ৫:৫৯ মিনিট পর্যন্ত ধনতেরাসের তিথি চলবে। আর শুরু হবে তার আগের দিন অর্থাৎ ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ৯:৩০ মিনিট থেকে। সাধারণত এই ধনতেরাসের অনুষ্ঠান উত্তর ভারতের হলেও এখন ভারতবর্ষ ছাড়িয়েও অনেক দেশে বেশ সুন্দর করে পালন করা হয়। ভগবান কুলের চিকিৎসক ধন্বন্তরিকে বিষ্ণুর আরেক রূপ বলেও ধরা হয়।ধনতেরাসের পূজার মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবনের কামনাও করা হয়। আর চতুর্দশী তিথিতে প্রতিটি বাড়িতে সন্ধেবেলা মাটির প্রদীপ দেওয়া হয়। এই প্রথাটি যমরাজের উদ্দেশে দেওয়া হয় যাতে গৃহে প্রবেশ করানো থেকে তাকে আটকানো যায়।
ধনতেরাস সম্বন্ধে কিছু অজানা ও মজার তথ্য
- ১৩ সংখ্যাটিকে বিশেষ করার উদ্দেশ্যে কোন ধাতব দ্রব্য কেনার প্রথা চালু হয় এবং বিশ্বাস করা হয় এই দিনে যে ধাতব দ্রব্যটি কেনা হয় তা তেরো গুণ বৃদ্ধি পায়।
- প্রায় ২৪ ঘন্টা ধনতেরাসের শুভ মহরত হলেও ধনতেরাসের পূজা সাধারণত সূর্যাস্তের পরই করা হয়।
- আর এই বছর এই প্রদোষকালটির বিস্তার বিকেল ৫:২৮ থেকে রাত ৮:০৭ পর্যন্ত অর্থাৎ পুজোর জন্য শুভ সময় এটিই। আর এই সময়ের মধ্যেও যারা সর্বোচ্চ বৃষভ কাল সন্ধান করছেন তাদের জন্যে যথার্থ সময় বিকেল ৫:৩২ থেকে সন্ধ্যে ৭:২৮ পর্যন্ত।
- তবে এক্ষেত্রে এটুকু জেনে রাখা ভালো এই দিনে পিতল বা তামার জিনিস অত্যন্ত শুভ হলেও স্টিল বা লোহার বাসন বা অন্য কোনো দ্রব্য না কেনাই ভালো। আর এই শুভ দিনে কোনো ব্যাক্তিকে ঋণ দেবেন না আর কারুর থেকে ঋণ গ্রহণ না করাই শ্রেয়। বিশ্বাস করা হয় এই দিনে ঋণ গ্রহণ করলে বা দান করলে তা তেরো গুন বৃদ্ধি পায়।
- তবে এই দিনে এই ধাতব জিনিস গুলির সাথে অন্যান্য যে জিনিস গুলি ক্রয় করতে হয় তা হলো হলুদ বা হরিদ্রা। হলুদ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করতে মানুষকে সাহায্য করে এবং সমস্ত রকম শারীরিক দুর্বলতা দূরে সরিয়ে রেখে শক্তিশালী করে রাখে। এই বিশ্বাসেই গোটা হলুদ বা একত্রিত হলুদের গাঁট কেনার চল দেখা যায় তবে যারা ব্যাপারটা জানেন না তারা টুকরো বা কাটা হলুদ কিনবেন না।
- আরেকটি প্রথাগত জিনিস কেনার চল দেখা যায় সেটি হলো লবন বা নুন। ধনতেরাসের দিন লবন ক্রয় করার প্রথাটিকেও খুবই শুভ বলে মানা হয় কারণ অশুভ শক্তিকে দূর করে শুভ শক্তিকে আহ্বান করার জন্যে লবণের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
- এর পরে আরেকটি জিনিসের কথা আমরা আলোচনা করতে পারি যেটি সোনা, রুপা বা তামার জিনিসের পাশাপাশি ধন ত্রয়োদশীর দিন ক্রয় করা আবশ্যিক। সেটি হলো ঝাড়ন বা ঝাড়ু। এটিকে সুফলদায়ক এবং বাড়ির নেগেটিভ শক্তিকে দূর করে সমস্ত রোগ কে দূরে রাখার জন্যে আবশ্যিক বলে মনে করা হয়। এছাড়াও লক্ষী কে আহ্বান করার জন্যে ঝাড়ুকে এই দিন বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। বাড়ির সামগ্রিক উন্নতির জন্যে ঝাড়ন বা ঝাড়ু ক্রয় করা হয়। আর বিশ্বাস করা হয় ঘুমানোর আগে কোনো ঝাঁটা বা বারুন কে দরজার সামনে রাখলে বাড়ির পসিটিভ শক্তি বাইরে বেরোতে পারে না আর নেগেটিভ শক্তিও ঘরে প্রবেশ করতে পারে না।
- ভগবান কুবের হলুদ রং পছন্দ করেন তাই হলুদ রঙের ফুল, মিষ্টি , পোশাক দান করা হয় , অনেক ভক্তরাও হলুদ রঙের পোশাক পরে এই দেবতার আরাধনা করেন তাকে প্রসন্ন করার উদ্দেশ্যে। তবে সোনা, রুপা বা কোনো দামি ধাতব পদার্থ কেনার যাদের সামর্থ নেই তারা যে কোনো যেমন গ্লাস, জগ বা মগ জাতীয় জলপাত্রও কিনতে পারেন।
- ধন্বন্তরী দেবের পূজার জন্যে সাদা রঙের ফুল, মিষ্টি ব্যবহার করতে পারি কারণ তিনি সাদা রং পছন্দ করেন। এবং এই জিনিস গুলো দীপাবলির পর গৃহস্থালির কাজে লাগানো যেতে পারে বা ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই বছরে আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি করোনা মহামারীতে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি এবং এখনও তার প্রভাব থেকে আমরা বেরোতে পারিনি। তাই সকলের মঙ্গলের জন্যে এইবছর আয়ুর্বেদ জনক ধন্বন্তরীর এবং ধনদেবতা কুবেরের পূজা করা আবশ্যিক বলে মনে করা যেতে পারে যাতে আমরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারি। এছাড়াও এইদিনে যারা অন্য কিছু কিনতে পারছেন না তারা চাল কিনতে পারেন কারণ চাল কেনাও শুভ বলে মানা হয়।
আমাদের বিশ্বাসের পিছনে যুক্তি
কোনো কিছু দান করা সবসময়ই মঙ্গলদায়ক বলে মনে করে হয় এবং এই ধনতেরাসের দিনও এর ব্যাতিক্রম হয়না। ভগবান কুবেরের একনেত্র বলে এই দিনে কোনো অন্ধ মানুষকে পোশাক, খাদ্য বা যে কোনো কিছু দান করা শুভকাজ বলে মানা হয়। এছাড়াও কোনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে কিছু দান করা শুভ বলে মানা হয়। এদের কিছু দান করে তার থেকে একটি সিকি বা কয়েন চেয়ে নিতে পারেন কারণ বলা হয় এই আশীর্বাদের বস্তুটি ঘরে রাখলে তা আশীর্বাদ স্বরূপ কাজ করে। আর বাড়ির লক্ষী অর্থাৎ মহিলাদের কিছু দেওয়া তাদের খুশি করা এই দিনে শুভ বলে মনে করা হয়। তবে এই জিনিসটি গোলাপি হলে ভালো বলে মনে করা হয়।